Saturday, August 16, 2025

চোদ্দ বছরের বিচ্ছেদের পর

 আগস্ট ২০২৫ টা ঠিক কিরকম বুঝিয়ে বলা মুশকিল। হঠাৎ করেই ১২ ই আগস্ট আমার শুক্ত মা চলে গেল। একই সপ্তাহে আমার একটা বিচ্ছেদ ঘটল খুব সামলে রাখা সঙ্গী বাবার দেওয়া "Whirlpool" এর ফ্রিজ টার সাথে। ওর ডিপ ফ্রিজ এর আচ্ছাদন টা খুলে পড়ে গিয়েছিল। অসুবিধা হচ্ছিল কাজ করতে। আমি তাও ওকে আলাদা হতে দিচ্ছিলাম না। আমি আজ পর্যন্ত ফ্রিজ, বিছানা ঘরে থাকার আসবাব পত্র কিছুই কিনি নি। কেনার প্রয়োজন ও বোধ করিনি। আমার গাজিয়াবাদ এর প্রাক্তন বাড়িতে আমি মাটি তে শুতাম কোনো বিছানা ছাড়া। তারপর বাবা একদিন আমার জুতোর তাক, ফ্রিজ, টিভি, টেবিল, চেয়ার, আলমারি সব নিয়ে এসে বাড়িটা কে সাজালো যখন বাড়ির চাবিটা মা, বাবা কে দিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা তখন ২০১১। তারপর বাবা আবার কলকাতা গেল, মা গেল । কলকাতায় অনেক গুলো বাড়ি কেনা হল। সবই আমার দাদার কেনা। আর আমি বাবার ঐ আসবাব পত্র গুলোকে একদম নিয়ে এসে জোরবাগ লেন এ বিকে দত্ত কলোনি তে উঠলাম। নতুন করে আর কিছু কেনার কথা কখনও মনে হয়নি। ২০১৪ বিশ্বকাপ টা দেখার জন্য একটি কম্পিউটার স্ক্রীন লাগালাম জাতে খেলা দেখতে পারি। কিন্তু অচিরেই বাবা আমার এই ভাড়া বাড়িতে আমার সাথে থাকতে লাগলো। কলকাতা থেকে আসলে সেই ফ্রিজ, খাট, ঐ গুলো ব্যবহার করত যা বাবাই কিনেছিল ছেলের থেকে বাড়ির চাবি পাওয়ার আনন্দে। আমি অবশ্য নিজের বাড়ি, তার সমস্ত জিনিষ পত্র গাজিয়াবাদের প্রান্তিক, উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের দিয়ে বি কে দত্ত কলোনি তে চলে আসলাম।

বাবাও চলে গেল 2016 তে। কিন্তু বাবার ফ্রিজ আমায় কখনো ছাড়েনি। কি অদম্য এক লেগে থাকার মানসিকতা নিয়েই শীত, গ্রীশ্ব, বর্ষা, তেরো পার্বণ, কোভিদ, পৃথিবীর রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে আমার সাথে থেকো গেলো। আমি মাঝে মাঝেই ওর সামনে গিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভাবতাম কত কিছু। বাকি সবাই কিরকম ভাবে 2011 থেকে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার ফ্রিজ টা সুঠাম বট গাছের মত বৃদ্ধ হয়ে আমাকে ওর ভেতরে ঠান্ডা ছায়া দিল। তারপর আজ হঠাৎ ও কিছুটা বলেই চলে গেল। জানিনা এই চলে যাওয়াটা কে কি বলে। ওর ও হয়তো একটা রূপান্তর ঘটল। সত্যিই কি এটা তাহলে চোদ্দ বছরের পর নতুন বিচ্ছেদ নাকি একটা নতুন অবলম্বন, দিক কে ধরতে পারা। আমি ঠিক জানিনা। তোমরা যদি জানতে পার আমাকে একটু বলো!

Tuesday, August 12, 2025

শুক্ত মা হওয়ার গল্প

মা শব্দ টা ঠিক প্রথম কবে বলেছিলাম খেয়াল নেই। কিন্তু মা হওয়া মানে কি তা বিভিন্ন সময় বুঝেছি। 

ঠিক যখন রফ, মাফিন, রফ জুনিয়র চলে গেল। তার আগে যখন মাফিন তার ছোটো বাচ্চাদের জন্ম দিল। দিনটা ছিল ধোনির অধিনায়কত্বে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার দিন। পুরো ভারত বর্ষ জয় উদযাপন করছিল। আমি খুশি ছিলাম মাফিন এর মা হওয়া নিয়ে। তার আগে মা হওয়া বুঝেছি যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এসেই চোখ কিছু মুহূর্তের জন্য মাকে দেখতে চাইছে। 

তখন 1999 সালে কভিড আসেনি। কিন্তু আমার কাছে উচ্চ মাধ্যমিক আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর ছয় ঘণ্টা গুলো এক একটি কোভিড এর ventilation system এর থেকে কিছু কম ছিল না। জীবনের এরকম বিভিন্ন মুহূর্তে হরেক রকম ভেন্টিলেশনে এ গিয়েছি। কিন্তু বেরিয়ে এসেই কোনো না কোনো মাকে পেয়েছি। সেই মা যারা কিনা বিভিন্ন রূপে, মহিমায়, এসে ধরা দিয়েছে আর ভালবেসেছে। কখন দিদি, বোন, বন্ধু হিসেবে। কিছুটা ভাগ্য, কিছুটা ভবিতব্য। জীবনের প্রতি তাই শুধুই আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা বোধ কাজ করে চলেছে।

কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি যে এক অভাবনীয় এক নারী কে আমার শুক্ত মা হিসেবে পাব। হ্যা। আমার শুক্ত মা। আমার দিদির শাশুরি আর জামাইবাবুর মা। উনি আমায় জন্ম দেন নি। কিন্তু সেই 2007, 2008 থেকে কোন কিছুর অপেক্ষা না করেই শুক্রবার করে কোনো না কোনো সময় আমার জন্য 
শুক্ত বানিয়ে রেখে গেছেন। ফোন করে বলেছেন - "তোর জন্যে শুক্ত বানিয়ে রেখেছি"। অথবা আমি যখনি দিদির বাড়ি যাবো অথবা আসবো শুনেছেন সব কিছু থামিয়ে রেখে সকাল থেকে একা সব্জি কেটে সবাইকে বলেছেন - "আজ সোনা আসবে, তাই শুক্ত হবে।"

তারপর আমি পৌঁছতেই বলে উঠেছেন - "কিরে চুল কাটবিনা।" 

আবার যখন চুল কেটে শুক্ত খেতে পৌঁছে গেছি, তখন বলে উঠেছেন - "বা, বেশ লাগছে এই তো "।

টেবিলে বসে থেকেছেন যাতে আমাকে বসিয়ে শুক্ত খাওয়াতে পারেন। তারপর সেই ফাঁকেই সঙ্গীত, বই, খেলা, সিনেমা কত কিছু নিয়ে আড্ডা। ওনার বেড়ে ওঠার গল্প। পড়াশুনা করার, জানার অদম্য তাগিদ - তার গল্প আর প্রতিস্ফূরণ। কত শুক্রবার, শনিবার, রবিবার এইভাবে কেটেছে। সকালে উঠে সবার আগে আমার জন্য চা করে, ওমলেট বানিয়ে দেওয়া নিয়মিত ভাবে করে গেছেন যাতে আমি না খেয়ে বেরিয়ে না যাই। 

আমার খাওয়া, দাওয়া, চুল, জামা, কাপড় নিয়ে উদাসীনতা তাকে ভাবাত। মারা বোধহয় এইভাবেই ভাবে। আমায় জন্ম দিয়েছেন যেই মা তাঁর প্রতিও আমার শুক্ত মায়ের কি নিগূঢ় ভালবাসা। মাকে নিয়ে অপারেশন এর পর যখন দিদির বাড়িতে 2019 এ প্রায় দুমাস থাকলাম, এক অন্য পৃথিবী ধরা দিল। পাশাপাশি দুই পৃথিবীর বন্ধুত্ব দেখলাম। আমার মা আর শুক্ত মা এক নিবিড় পারস্পরিক শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়ে বন্ধু হয়ে গেলেন বই, পড়াশোনা, আলোচনার মধ্যে দিয়েই। কী আধুনিক সেই দুই পৃথিবী। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই বিরল। দুজনেই স্বামী হারিয়েছেন সেই সময়, কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব এক পিতৃ তান্ত্রিক সমাজের প্রেক্ষাপটে কি বিরল। আমি না দেখার ভান করেই দেখে গিয়েছি।

আজ হঠাৎ একটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। হয়ত স্তব্ধ নয়। জাতিস্মর হয়ে গেল পরজন্মের জন্য। শুক্ত মা চলে গেলেন।
ঠিক কিছুদিন আগেই রাখির দিন যখন উনি হাসপাতাল এ লড়াই করছেন, দিদি কে বললাম - "জেঠির মত শুক্ত বানিয়েছ কি?"

খাওয়ার পর বললাম - "একদম স্বাদ এসে গেছে। "

শুক্ত মা যারা, তাঁরা ঠিক এভাবেই এসে আর থেকে যান জন্মান্তরের জন্য।


শুক্ত

 আমার শুক্ত টাও চলে গেল 

চোখের জলে আলোর নৌকাগুলো 

বর্ষার দিল্লিতে তৈরি যেন 

বর্ষাতি গুলো টুকরো কেন?